কেন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে?

গণতন্ত্রকে বলা হয় মানুষের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা। এখানে সাধারণ মানুষ তাদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব নির্বাচন করে, আইন তৈরি করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিশ্বের অনেক দেশেই গণতন্ত্র সফলভাবে টিকে থাকতে পারেনি। কোথাও স্বল্প সময়ের জন্য টিকেছে, কোথাও আবার একেবারেই কার্যকর হয়নি। অথচ উন্নত বিশ্বে যেমন ইউরোপ, আমেরিকা বা কিছু এশীয় দেশে গণতন্ত্র বহু বছর ধরে টিকে আছে। তাহলে প্রশ্ন হলো— কেন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি সাংস্কৃতিক দিকগুলোও বিশ্লেষণ করতে হবে। নিচে পর্যায়ক্রমে বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো।


১. দুর্বল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান

গণতন্ত্র কেবলমাত্র ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি টিকিয়ে রাখতে দরকার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান— যেমন স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন, সংসদ, গণমাধ্যম, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ইত্যাদি। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের চেয়ে শক্তিশালীভাবে কাজ করে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে।

কিন্তু অনেক দেশে এসব প্রতিষ্ঠান দুর্বল বা সরকারনির্ভর। বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক চাপে নতি স্বীকার করে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকে না, সংসদ কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে গণতন্ত্র কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে একনায়কতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।


২. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য

গণতন্ত্র টিকে থাকতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তরা সাধারণত শিক্ষা, অধিকার, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার পক্ষে থাকে। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী যখন দৈনন্দিন খাবার, চাকরি বা নিরাপত্তার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে, তখন তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে তাৎক্ষণিক সুবিধাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

অর্থনৈতিক বৈষম্য গণতন্ত্রের বড় শত্রু। ধনী শ্রেণি রাজনীতি ও নির্বাচনে অর্থ ঢেলে নিজেদের পক্ষে ক্ষমতা ব্যবহার করে। দরিদ্ররা প্রভাবিত হয় টাকার বিনিময়ে ভোট দেওয়া, অথবা ক্ষণস্থায়ী সাহায্যের বিনিময়ে। এভাবে ভোটের মাধ্যমে আসলে গণতন্ত্র নয়, বরং ধনীদের ক্ষমতা টিকে থাকে।


৩. সর্বব্যাপী দুর্নীতি

দুর্নীতি গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও আমলারা আইনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। যখন মানুষ দেখে যে আইন, নির্বাচন বা সরকারের সিদ্ধান্তগুলো টাকার বিনিময়ে বদলে যায়, তখন গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়।

ফলে জনগণ ভাবে— “গণতন্ত্রে কিছুই পরিবর্তন হয় না, বরং একজন শক্তিশালী একনায়ক দরকার যে অন্তত শৃঙ্খলা আনতে পারবে।” এই মানসিকতা গণতন্ত্রকে আরও দুর্বল করে দেয়।


৪. জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভাজন

অনেক দেশে জনগণ একক জাতি, ধর্ম বা সংস্কৃতির নয়; তারা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। গণতন্ত্রে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন সংখ্যালঘুরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।

উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার অনেক দেশে গোত্রভিত্তিক রাজনীতি হয়েছে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোত্র ক্ষমতায় এসেছে, তারা সংখ্যালঘুদের ওপর দমননীতি চালিয়েছে। এর ফলে গণতন্ত্র সেখানে পরিণত হয়েছে “সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্রে।” এমন পরিস্থিতিতে দেশ অস্থিতিশীল হয়, কখনও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, আবার কখনও সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়।


৫. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব

গণতন্ত্র শুধু ভোট নয়; এটি হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, এবং মতবিরোধ মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি। অনেক দেশে এখনো নেতৃত্ব মানে হলো “অন্ধ আনুগত্য” বা “শক্ত হাতে শাসন।”

যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে প্রতিপক্ষকে দমন করে, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করে— সেখানে গণতন্ত্র কাগজে থাকলেও বাস্তবে তা অকার্যকর।


৬. বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ

অনেক সময় বিদেশি শক্তি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তেল ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বিদেশি শক্তি গণতন্ত্র সমর্থন না করে বরং স্বৈরশাসকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কারণ, গণতান্ত্রিক সরকার এলে হয়তো বিদেশি শক্তির স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতো।


৭. জনতাবাদ ও কর্তৃত্ববাদী প্রলোভন

গণতন্ত্র কখনও কখনও ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ে। যখন জনগণ দুর্নীতি, বেকারত্ব বা অপরাধে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন তারা এমন নেতাদের ভোট দেয় যারা “শক্ত হাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার” প্রতিশ্রুতি দেয়।

এই নেতারা ক্ষমতায় এসে প্রথমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়, কিন্তু পরে সংবাদমাধ্যম দমন করে, বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজেদের আজীবন ক্ষমতায় রাখে। ফলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে একনায়কতন্ত্রে রূপ নেয়।


৮. তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও ভুয়া প্রচার

গণতন্ত্রে নাগরিকদের সচেতন ও সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন সরকার বা শক্তিশালী গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন মানুষ প্রকৃত সত্য জানতেই পারে না।

বর্তমান যুগে আবার “ভুয়া খবর” বা ফেক নিউজ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে জনগণকে প্রভাবিত করা হয়। ফলে ভোটাররা অনেক সময় ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।


উদাহরণ: কোথায় কোথায় গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে?

  • মিশর: ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠিত হয়েছিল, কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়।

  • ভেনেজুয়েলা: গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়, আজ সেখানে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট।

  • মিয়ানমার: বারবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সেনাবাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *